১৭৩০ খ্রি. আর্বিভাব ১৮৯০ খ্রি. তিরোভাব সুবিন্তৃত ১৬০ বছরকাল এর মধ্যে ৯০ বছর সাধনকাল।পরবর্তী ৩৩ বছর দেশ মহাদেশ পরিক্রমা অবশিষ্ট ২৬ বছর মহাতীর্থ বারদীধামে জগৎ কল্যাণে নিজেকে উজাড় করে দেব। স্বর্গমুখী বা আত্ম উন্নয়নমুখী সাধু অনেক দেখা যায়। কিন্তু জগৎ কল্যাণমুখী সাধু বিরল। এখানেই অনাথের নাথ লোকনাথ নামের মাধু্র্য। নামের মধেই পরোপকারের ব্রতটি যিনি ধারন করে দীর্ঘ ২৬ বছর বারদীধামে অবস্থান নিয়েছিলেন। ত্যাগ ও সেবার মহিমায় যার জীবন মহিমানিত যোগীরাজ বারদীধামে অবস্থানকালে সন্ধায় আশ্রম বন্ধ হয়ে যেত, কিন্তু বন্ধ হত না মহাযোগী বাবা লোকনাথের আশ্রমে আসা অন্যান্য যোগীদের শিক্ষা মূলক কার্যক্রম। গভীর রাত পর্যন্ত যোগীদের শিক্ষাদান পর্বটি চালিয়ে নিতেন। কঠোর ব্রক্ষ্মচর্য ব্রতের নিয়মাবলি পালনে কোনো আপোষ করেননি। আপোষ করেনি তাই তীব্র কৃচ্ছ্রতা সাধনে। আচরণ ধারন করা সাধনার বিষয়, করুণা ও কৃপার বিষয়।
বাবা লোকনাথ বলেছেন - তোদের অভীষ্ট বা মানত পূরণ হলে মহৎ ব্যক্তি হিসাবে আমাকে মনে করিস। কিন্তু ভবরোগের বিষয়ে কোনো ব্যক্তি আমার নিকটে আসে না। আরোও বলেছেন - "তোরা যখন কর্ম করিস তখন ভালো-মন্দ দুটিই করিস।" মন্দ কর্ম যাতে না করতে হয় সে জন্য দূঢ় প্রতিজ্ঞ হবি। প্রতিদিন নিদ্রা যাবার পূর্বে ভালো মন্দ কাজের হিসাব করে পরদিন যাতে মন্দ কর্ম না করতে হয়। ফলে মন্দ কর্মের পরিবর্তে শুভ কর্ম বৃদ্ধি পাবে। এতে আরো মঙ্গল হবে।
যিনি নিরাশ্রয়কে আশ্রয় দেন, যিনি সর্ব কারণের কারণ, অনন্ত প্রমের সাগর তার অপার মহিমায় হৃদয় প্রেমাপ্লুত হয়েছিল কর্মযোগী অনিল কুমার মুখার্জীর চলার পথ।যার অনুপ্রেরণায় সারা বাংলাদেশ লোকনাথ প্রেমের বন্যায় ভেসে চলেছে ভক্তবৃন্দ। লোকনাথগত প্রাণ অনিল কুমার মুখার্জী বাবা লোকনাথের দর্শন প্রচারের ভগীরথ। প্রতিঘরে লোকনাথ নামের মহিমা প্রচারে নিবেদিত প্রান ছিলেন।অসহায় পরিবারের স্বাস্থ্য সেবা ও শিক্ষার আলো পোঁছানোর উদ্দেশ্য ১৯৯২ সনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যায়ে প্রতিষ্ঠা করেন "লোকনাথ সেবা সংঘ"।ফলে কর্ম জ্ঞান ভক্তি, সেবা ও শান্তির পতাকা তলে ঐক্যবদ্ধ হয়ে তরুণ প্রাণে লোকনাথ দর্শন ছড়িয়ে পড়ে। বারদীধামে ভক্তদের উদ্দেশ্য বাবা ঘোষণা করলেন - তোদের ভগবানের সাথে আমার দেখা হয় নি। আমি দেখেছি আমাকে। আমি বদ্ধ আছি সংসারে, সংসার বদ্ধ আছে কর্মে,কর্ম বদ্ধ আছে জিহ্বা আর উপস্থে, যে এই দুটি সংযম করতে পেরেছে সেই সিদ্ধি লাভ করেছে। জিহ্বা মানে লোভের আশ্রয়ে বিভিন্ন অর্থনৈতিক কাজে জড়িয়ে পড়া। প্রয়োজনের অতিরিক্ত গ্রহণের মানসিকতা। লোভের পূজা না করে ক্ষুধার পূজা করতে বলতেন। চাহিদার সাথে প্রাপ্তি সম্বন্বয় না থাকলে বিকারগ্রস্ত হওয়ার প্রবণতা দেখা যায়।
উপস্থ (লিঙ্গ) বিষয়ে - বাবা বলতেন "ব্রহ্মচর্যই মহাশক্তির মূল উৎস"। এই শক্তিকে আমার অপ্রয়োজনে ব্যবহার করে আত্ম্যহত্যার পথেই এগিয়ে যাচ্ছি। কামনার আঁধারে মানুষ পশুত্বে রূপান্তর হয়। এর সঠিক ব্যবহারে মানুষ মানবে পরিণত হয়। শ্রীশ্রী গীতার ভাষায় - কামনায় নরকের পথ প্রশস্ত করে। আবার কামের বিনাশে প্রমের আর্বিভাব। সংযম,সুচিতা,সত্যবাদিতা ও পরোপকার ব্রতের প্রবণতা বিষেয় সচেতন হওয়ার প্রচেষ্টা চালানো। ব্যাক্তি কল্যাণে নিবেদিত প্রান ব্যাক্তি সমষ্টি কল্যাণে এগিয়ে যাওয়া, তা হলেই মঙ্গলময়ের কৃপা লাভের পথ সুপ্রসশস্ত হবে সমষ্টি কল্যাণে নিবেদিত প্রাব ব্যক্তি কল্যাণের সোপান। যোগীরাজের ভাবনায়- জীবের প্রার্থবা বা উওয়ানবা মঙ্গলময় গ্রহব করেব। গ্রহন করেন শ্রদ্ধাঞ্জলি এ ভাবেই স্রষ্টার সাথে সৃষ্টির নৈকট্য লাভ হয়।
২
চরণ না ধরে আচরণ ধর তাতেই হবে রূপান্তর
বিষ্ণুপদ ভৌমিক
লোকনাথ ঘোষালকে তাঁর মহাজীবনের প্রথম অধ্যায়ে সীতানাথ বন্দ্যোপাধ্যায় নাম ধরে ৪০ বৎসর গৃহ সন্ন্যাসীর জীবন ধারায় কঠোর ব্রহ্মচর্য ব্রত পালন করতে হয়েছিল। দ্বিতীয় অধ্যায়ে সীতানাথের দেহান্তে লোকনাথ ঘোষাল লোকনাথ ব্রহ্মচারী রূপে রুপান্তরিত হতে ৯০ বৎসর কঠোর ব্রহ্মচর্য ব্রত পালন করে কর্মযোগে সিদ্ধিলাভ করেন।
সনাতন ধর্মে জন্মান্তর বাদ সুপ্রতিষ্ঠিত বিশ^াস এর উপর চলমান। যুগে-যুগে আগত মুনি ঋষি ও মহাপুরুষগণ প্রারব্ধবাদকে গ্রহণ করেছেন। পূর্ব জন্মের কৃত কর্মের শুভ ও অশুভ কর্মের ফলাফল ভোগ করতে হবে। এ বিষয়ে সংসারাসক্ত মানুষকে সচেতন করার জন্য মহাপুরুষদের স্মরণ ও মননেব্রতী হওয়ার জন্য আহবান। সকল দুঃখের কারণ অচেতন মোহগ্রস্ত যাপিত জীবন, চেতনার জগতে বিচরণ আর কায়মনোবাক্যে সত্য, সংযম, পবিত্রতা, অহিংসা এবং অক্রোধী হওয়ার জন্য দৃঢ় সংকল্প হওয়া।
বেদমূর্তি মহাযোগী লোকনাথ বাবা বলেছেন কর্মই ব্রহ্ম, দুঃখ বেদনা আমাদের কৃত কর্মের ফসল। কর্ম শুদ্ধ হলে ধর্মও শুদ্ধ হয়, অশুদ্ধ কর্ম বিশুদ্ধ ধর্মের ঠিকানা দিতে ব্যর্থ প্রয়াস চালায় ফলে কর্ম জীবন উৎকৃষ্ট ফল দানে ব্যর্থ হয়। রাজা শুদ্ধধনের ছেলে গৌতম বুদ্ধে রূপান্তরিত হয়েছিলেন সুদীর্ঘ কাল কঠোর সাধনার ফলে। ভক্ত কবীর দাসের ভাবনা দুঃখের সময় জীব মাত্রই ভগবৎস্মরণ করে তাঁর স্মরণাগত হওয়ার তীব্র বাসনা জাগে।
প্রতিটি ইট নির্দিষ্ট তাপে পুড়িয়ে উৎকৃষ্ট ইট তৈরী করে সুরম্য অট্টালিকা নির্মাণে ভূমিকা রেখে চলেছে। মহাযোগী বাবা লোকনাথ তাঁর পূর্ণ অবস্থায় অধিষ্ঠিত হয়ে পরম ভাবের বিষয়ে বিশ^বাসীকে জানিয়েছেন। আমি নিত্য, শুদ্ধ, নিরাভাস নির্বিকার অহং এর নাশ তাঁর উদয়ে তখন ভেদজ্ঞান থাকেনা, থাকেনা উচু নিচু থাকেনা বংশ পরিচয়। সৃষ্টিকর্তা একজন। তা হলে ¯্রষ্টার সৃষ্টি বিভিন্ন পর্যায়ে রূপান্তর হয়েছে তার কারণ সৃষ্টিকর্তা সৃষ্টির ভিতরে নিজেকে আড়াল করে রেখেছেন। ¯্রষ্টার রহস্যময় আরাল উন্মোচন করার জন্য ভক্তের সাথে তার গোপন অভিনয় করে চলেছেন। সেই অভিনয় ক্ষেত্র বিচিত্র রহস্যময়। সেই রহস্য ঘেরা প্রাচীর অতিক্রমের জন্য কর্মযোগ-জ্ঞান-যোগ ও ভক্তিযোগের চাষাবাদ করলে উৎকৃষ্ট ফসল ঘরে তুলতে পারা যায়। বাবা লোকনাথ কর্মযোগের সাধন চর্চায় নিজ সত্ত্বাকে বিলীন করে ভগবৎ সত্বায় উত্তীর্ণ হয়েছিলেন।
চ্যবন মুনির পুত্র রতœাকর প্রথম জীবনে জীবিকা হিসেবে দস্যু বৃত্তিকে বেছে নেন কারণ এ পথে অতি দ্রুত সম্পদশালী হওয়া যায়। এ ভাবে পথিকের যথাসর্বস্ব কেড়ে নেয়া এবং হত্যা করা তার পেশা হয়ে গিয়েছিল। চিরদিন কারো সমানভাবে অতিবাহিত হয় না। রতœাকরের বেলায় তাই হয়েছিল। হঠাৎ বনের পথ দিয়ে দুই সন্ন্যাসী রাস্তা অতিক্রম করছিল ঠিক তখনই রতœাকর তাদেরকে হত্যা করার উদ্যোগ নেয়। সন্ন্যাসী একজন বলে ওঠে আমাদের কে হত্যার পূর্বে তোমার এই কৃত কর্মের ফল তোমার সংসারে কে বহন করবে তা তুমি জেনে এসে আমাদের কে হত্যা করো।
রতœাকর পড়ে ফাঁপড়ে। সে কি উত্তর দেবে ? হঠাৎ তার মনে পড়ে যাদের পালন করার জন্য সে দিনের পর দিন এই অশুভ কর্ম সম্পাদন করে চলেছে তারাই তার কৃত কর্মের অর্থ্যাৎ এই পাপের ভাগ বহন করবে। এ ভানায় সে মাতা, পিতা, স্ত্রী ও পুত্রের সাথে মত বিনিময় করে। তোমাকে অনেক কষ্ট করে ছোট বেলায় আমরা লালন পালন করেছি। দশ মাস দশ দিন তোমার মা তোমায় গর্ভে ধরেছে। এখন তোমার পাপের বোঝা আমরা কেন বহন করব পিতা মাতার এ কথা শুনে রতœা কর
স্ত্রীর নিকট এ বিষয়ে মতামত চাইলে স্ত্রী বলেন আমি তোমার অর্ধাঙ্গিনী ও তুমি আমাকে অগ্নিসাক্ষী করে ভাত কাপড় দেবে বলে প্রতিজ্ঞা করে গ্রহণ করেছ। আমি তোমার এ হেন পাপের ভাগ বহন করার প্রশ্নই ওঠেনা। পতœীর উত্তর শুনে রতœাকর একেবারে স্তম্ভিত! এ সে কী
৩
আস্থা ও ঐক্যের প্রতীক বাব লোকনাথ
প্রণব চক্রবর্তী
১৯শে জ্যৈষ্ঠ শ্রীশ্রী লোকনাথ ব্রহ্মচারী বাবার ১২৯তম তিরোধান দিবস। ১৬০ বছর বয়সে তিনি পৃথিবী ছেড়ে যান। বঙ্গাব্দ ১১৩৭ সনে এই ধারাধামে আবির্ভূত হয়ে কঠোর সাধনায় তিনি ব্যাপৃত ছিলেন। মানুষের কল্যাণে নিবেদিত থেকেও নিজেকে তিনি বিশেষভাবে ব্যাখ্যা করেননি। বলেছেন- “ঈশ^রই একমাত্র সদ্গুরু। আমার চরণ ধরিসনা - আচরণ ধর।”
বারদীতে তাঁর আশ্রম। গোয়ালিনী মা ছিলেন আশ্রম রক্ষয়িত্রী, কৈবর্ত মেয়ে ভজলেরাম আশ্রম - সেবিকা। মোহনগিরি ও বৌমভোরা হিন্দুস্থানী ভক্ত, ষাঁড় কালাচান, আদরিনী বিড়াল, কুকুর, সাপ পাখি সবার সমান অধিকার ছিল এই আশ্রমে।
তিনি ছিলেন ত্রিকালজ্ঞ। কঠোর যোগ সাধনার মাধ্যমে তিনি জনত্রাণে তাঁর অলৌকিকত্বের ছাপ রেখে গেছেন। দুখী, সম্পদহীন, নি¤œ আয়ের মানুষ ধর্ম, বর্ণ, গোত্র, নির্বিশেষে তাঁর ¯েœহলাভে ধন্য হয়েছে।
তাঁর অমোঘবাণী বিশ^জনীন দর্শনকে প্রতিভাত করে। “সত্য পালনই প্রকৃত ধর্ম। যারা সত্য রক্ষা করেনা তারা বিধর্মী, তারা অপরাধী। তাদের গতি নরকে। তারা শাস্তি পাবার যোগ্য।”
মানুষকে সত্যের পথে উদ্বুদ্ধ করতে তাঁর উপদেশবাণী সমাজে অর্থবহ উদ্দীপনার সৃষ্টি করেছে। শুধু বারদী নয়, দূর দূরান্তরের মানুষ আর্ত, পীড়িতকে নিয়ে তাঁর কৃপা ভিক্ষায় যখনই এসেচেন তিনি আশীর্বাণী বর্ষণ করেছেন।
সব ধরনের, সব বয়সের নারী পুরুষ তাঁর কৃপালাভের সুযোগ পেয়েছেন। তিনি ছিলেন সবার জন্য আস্থার প্রতীক। তাঁর বাণী তাই- মানুষের মুখে মুখে ফিরে। “রণে, বনে, জলে, জঙ্গলে যখনই বিপদে পড়িবে, আমাকে স্মরণ করি ও - আমিই রক্ষা করিব।”
তিনি পরমবন্ধু হিসেবে, রক্ষাকর্তা হিসেবে সবার আস্থার, প্রতীক হয়েছেন। সংসার ও সময়ের জটিলতায় পর্যুদস্ত মানুষ যখনই অসহায়ত্বে পড়েন তিনি তাঁর বাণীর মাধ্যমে তাকে সাহস যোগান, আশ্রয়ের সন্ধান দেন, শান্তির ঠিকানা জানান।
এই উপমহাদেশের দু’টি প্রধান ধর্ম হিন্দু ও ইসলাম ধর্মের চর্চায়ও তিনি অগ্রসর গুরু। তিনি কাবুল ও মক্কা পরিভ্রমণ করেন। তিনি বলেছেন, “আমরা কাবুলে মোল্লা সাদির বাড়িতে থেকে তাঁরই নির্দেশে পবিত্র কোরান শিক্ষা করি।” শুধু তাই নয় তিনি আরও বলেছেন “আমি এত পাহাড়, পর্বত ভ্রমণ করেছি কিন্তু তিনজন বৈ ব্রহ্মণ দেখিনি। মক্কাতে আবদুল গফুর, ভারতে তৈলঙ্গস্বামী ও বাবা লোকনাথ নিজে।”
হিন্দু-মুসলমান সবার প্রতি সমান দৃষ্টি বারদীর স্থানীয় মুসলমানদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে এবং তাদের কাছে তিনি সিদ্ধ পীরবাবা নামে খ্যাত হন।
একবিংশ শতাব্দী কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ও রবোটিক্সের যুগ। বিপরীত দিকে এ শতাব্দী একাকীত্ব ও অস্থিরতার যুগ। সমাজগুরু হিসেবে বাবা লোকনাথের দর্শন এই অস্থিরতায় আস্থা ও ভরসাস্থল হিসেবে মানুষকে কল্যাণ ও সমৃদ্ধির সন্ধান দিতে পারে। করতে পারে ধর্মীয় ঐক্যের বন্ধনে সবাইকে আবদ্ধ। তাঁর সাম্য ও সমতার পথ নির্দেশ আমাদের সবার জন্য সুন্দর আগামী নিশ্চিত করতে পারে।
‘যতক্ষণ তোর অসন্তোষ ততক্ষণই তোর দারিদ্র্য” ক্ষয়িষ্ণু নৈতিকতা ও সততার এই সময়ে হতাশা ছেড়ে আমরা বাবা লোকনাথের নির্দেশনা অনুসরণ করে সবার জন্য সুখ ও সমৃদ্ধি নিশ্চিত করতে পারি।
জয় বাবা লোকনাথ।
Page 1 of 1, showing 3 records out of 3 total, starting on record 1, ending on 3